Friday, July 22, 2011

দ্য প্রফেট অনুবাদ-07


অতঃপর রমণী এক তাকে বলল, তুমি আমাদের সুখদুঃখের কথা বল।
জবাবে সে বলল:
তোমাদের সুখ হ’ল অনবগুন্ঠিত বেদনা
তোমাদের যে হাসির ফোয়ারা ওঠে সেই কূপেই ঝরতে থাকে তোমাদের অশ্রুজলের ঝর্ণা।
এছাড়া আর কী-ই বা হ’তে পারে তবে?
তোমাদের দুঃখকে যত সত্তার গভীরে খনন করবে ততই গভীরে তার তোমাদের আনন্দসুখ ভরে উঠবে।


তোমাদের সুধাসুরা যে পানভাণ্ডে ভরা থাকে তা কি কুম্ভকারের চুল্লিতে দগ্ধশুদ্ধ নয়?
তোমাদের আর্ত মনকে যে বাদ্যবীণার সুরধ্বনি আমোদিত করে তার শূন্য ছিদ্র কি ছুরিকা দিয়ে গড়া সেই দারুকাষ্ঠ নয়?
তোমরা যখন আনন্দসুখে উৎফুল হও তখন তোমরা তোমাদের হৃদয়ের গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপ কর, তোমরা দেখতে পাবে যে যা তোমাদের দুঃখ দিয়েছিল তা-ই আদপে তোমাদের আনন্দের হেতু
তোমরা যখন ব্যাপ্ত পরতাপে কাতর তখন তোমরা পুনর্বার তোমাদের হৃদয়ের গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপ কর, তোমরা দেখতে পাবে যে তোমরা যার জন্য বিলাপ করছ তা-ই তা-ই আদপে তোমাদের আনন্দের হেতু।
কেউ বলে ’দুঃখের চেয়ে আনন্দ মহান’, কেউ বলে ’না, দুঃখই মহান’
আমি বলি, তারা অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বিরাজমান।
তারা একই সঙ্গে আসে, একজন যখন তোমাদের সঙ্গে তোমাদের অলিন্দে বসে থাকে অন্যজন তখন তোমাদের শয্যায় থাকে শয়ান।
তোমরা বস্তুতঃ তোমাদের সুখদুঃখের ওলনদণ্ডে আলম্বিত ভাসমান
তোমরা তখনই শুধু নির্ভার নিঃশূন্য যখন তোমরা ধীরস্থির ভারসাম্যতায় সুসমান।
তোমরা তখনই সুখদুঃখে উত্থিত হও পতিত হও যখন তোমরা ধনরক্ষকের স্বর্ণরৌপ্যের তুলাদণ্ডে দণ্ডিত হও অসমান।



অতঃপর ঘরামি এক এগিয়ে এসে বলল, তুমি আমাদের ঘরবাড়ি নিয়ে কিছু বল।
জবাবে সে বলল:
নগরপ্রাকারে বসতি স্থাপনের আগে তোমাদের কল্পনার নিকুঞ্জবনে তোমরা এক বাড়ি বানাও।
গোধূলিলগ্নে তোমরা যেমন নীড়ে আসো, প্রত্যন্ত একান্তে চিরবাসী তোমাদের আত্মভূত পরিব্রাজক সে তেমনই ফিরে আসে আপন আবাসে, তোমরা যেন বিষ্মৃত না হও।
তোমাদের বৃহত্তর দেহভূমই তোমাদের আবাস, সেখানেই তোমরা চিরবাসী হও।
দিবসসূর্য্যের প্রতাপে তা বেড়ে ওঠে আর নিথর রাত্রিনিশীথে নিদ্রাগত হয়, সেই রাত্রিনিশীথ কখনও স্বপ্নহীন নয়। তোমাদের দেহনিবাস কি স্বপ্ন দেখে না? এবং স্বপ্ন দেখতে দেখতে নগর ছাড়িয়ে নিকুঞ্জবনে পর্ব্বতচূড়ায় কি হ’য়ে যায় না উধাও?

তোমাদের ঘরবাড়ি সব যদি আমার হাতের মুঠোয় কব্জা করতে পারতাম তবে সেসব আমি বীজবপকের মত বনজঙ্গলে মাঠেঘাটে ছড়িয়ে দিতাম, এমন যদি হ’ত কখনও
তোমাদের উপত্যকাগুলো যদি হ’ত তোমাদের চলার পথ আর সবুজ ঘাসঘাসালি হ’ত তোমাদের চলার পথের অলিগলি তবে তোমরা এক অপরকে খুঁজে বেড়াতে আঙুরক্ষেতে আর তোমাদের পোশাক থেকে ছড়িয়ে পড়ত মাটির সোঁদালো গন্ধ, এমন যদি হ’ত কখনও
কিন্তু এমন তো হয় না কখনও।
তোমাদের পূর্ব্বপুরুষগণ কোন অজানা আশঙ্কায় তোমাদেরকে একসঙ্গে বড় কাছাকাছি করে রেখে গেছেন। সেই আশঙ্কা রয়ে যাবে আরও কিছুকাল, আরও কিছুকাল মাঠপ্রান্তর থেকে তোমাদের উনানচুল্লীকে দূর করে রাখবে এই নগরপ্রাকার, আরও কিছুকাল এখনও।

তোমাদের এই ঘরবাড়িতে এমন কী আছে, হে অরফালিজবাসীগণ, তোমরা আমাকে বল। কী সেই জিনিষ তোমরা দুয়ার অর্গলবদ্ধ করে পাহারা দাও?
তোমাদের কি শান্তিস্বস্তি আছে, আছে কি সেই পরম প্রেরণা যাতে তোমরা তোমাদের অন্তর্গত ক্ষমতার সায় পাও?
তোমাদের কি এমন স্মৃতি আছে যে তার প্রোজ্জ্বল খিলান তোমাদের চিত্তগম্বুজকে ব্যাপ্ত করে রাখে সর্ব্বময়?
তোমাদের কি এমন সৌন্দর্য্য আছে যে তা তোমাদের হৃদয়কে কাষ্ঠপ্রস্তরময় বস্তু থেকে পবিত্র পাহাড়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় সবসময়?
আমাকে বল, সত্যই কি এইসব কিছু আছে তোমাদের ঘরবাড়ির আবাসময়?
না কি শুধুই আরাম-আয়াস লালসাবিলাস নিশীথের অতিথির সাজে গৃহকর্তার মত গৃহে প্রবেশ এবং তারপর তার প্রভুর প্রভুত্বে প্রভাস?
হ্যাঁ, তারপর হয়ে ওঠে সে পোষকর্তা, কাঁটাচাবুকের কষায় পোষ মানিয়ে তোমাদের বৃহত্তর কামনা-বাসনার করে পুতুলনাচ অন্তর্নাশ।
কোমল পশম হাত তার, হৃদয় লৌহ কঠিন
তোমাদের ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে সে শয্যাপাশে দাঁড়িয়ে উপহাসে তোমাদের অস্থিমজ্জার জীবনকে করে কৌলিন্যহীণ।
তোমাদের দৃঢ় বিশ্বাসকে অবহেলায় ঠুনকো ভাঁড়ের মত নিক্ষেপ করে কাঁটাজঙ্গলে।
তোমাদের আরাম-আয়াস লালসাবিলাস প্রকৃতই তোমাদের আবেগঘন অন্তরাত্মাকে হনন করে আর হাসতে হাসতে সামিল হয় তার অন্ত্যেষ্টির অন্তঃসলিলে।
অসীম অনন্তের সন্তান তোমরা, অস্থৈর্য্যেও ধীরস্থির তোমরা কখনই তার ফাঁসবন্দী হবে না, কখনই তার বশ্যতার শিকার হবে না
তোমাদের ঘরবাড়ি হবে মাস্তুলের মত, কখনই তা বন্দরে নোঙর ফেলবে না
তোমাদের ঘরবাড়ি হবে নেত্ররক্ষার নেত্রপল্লব, দেহক্ষত ঢাকার দ্যুতিময় ঝিল্লি হবে না
দরজায় ঢোকার সময় তোমাদের ডানা গোটাবে না তোমরা কিংবা ছাদে মাথা ঠুকলেও তোমরা মাথা নত করবে না, দেওয়াল ফেটে চৌচির হ’য়ে যায় যাক্ তবুও ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করবে না
তোমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা জীবিতদের জন্য যে সমাধিক্ষেত্র বানিয়ে রেখে গেছে তোমরা সেখানে বাস করবে না
এবং তোমাদের ঘরবাড়ি যতই শোভনসুন্দর হর্ম্মসৌধ হউক্ সেখানে কোন গোপনীয়তা থাকবে না কিংবা তোমাদের কোন কামনা-বাসনা।
তোমাদের মধ্যে যা অসীম অনন্ত মহাকাশ সৌধে তার বাস, দরজা খোলা তার ভোরের কুয়াশায়, বাতায়ন তার রাত্রির নৈঃশব্দ আর সঙ্গীতের বন্দনা।




এবং এক তন্তুবায় এসে বলল, তুমি আমাদের পোশাকপরিচ্ছদ সম্পর্কে কিছু বল।
এবং সে বলল:

তোমাদের পোশাকপরিচ্ছদ তোমাদের সৌন্দর্য্যের অনেক কিছুকেই আড়ালে ঢাকা দিয়ে রাখে, অথচ অসৌন্দর্য্য রয়ে যায় অঢাকা
এবং তোমরা পোশাকপরিচ্ছদের আড়ালে একান্ত গোপনীয়তার স্বাধীনতার সন্ধান কর যা তা তো আদপে লাগামবেড়ীর শৃঙ্খলে শরীর ঢাকা।
পোশাকআশাকে কী হবে তোমার? তার চেয়ে বরং অনেক ভালো আদুল গায়ে সূর্য্যদাহে সুসমীরে শরীর স্যাঁকা
সূর্য্যতাপেই প্রাণবায়ু, সুসমীর সুবাতাসেই জীবনের করস্পর্শ, নিছকই তোমাদের শরীর ঢাকা।

কেউ কেউ বলে, ”উত্তুরে হাওয়া-ই আমাদের বস্ত্রের বুনট”।
আমিও বলি, হ্যাঁ, উত্তুরে হাওয়াই তোমাদের বস্ত্রের বয়ন বুনট
লজ্জ্বা হ’ল তার তাঁত, নরম পেশীর তন্তুতে তার সূত্র বয়ন
আর কর্ম্ম সমাপন্তে হাসিতে হাসিতে তার অনুরণন।
বিষ্মৃত হ’য়ো না যেন শালীনতা হ’ল কুশ্রী দৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়ার রক্ষাবর্ম্ম
কদর্য্য কুশ্রীতা থাকবে না যখন তখন শালীনতা আর কী-ই বা শুধুই মনের শৃঙ্খলবেড়ী পুঁতিগন্ধে গলদঘর্ম্ম?
এবং বিষ্মৃত হ’য়ো না কখনও যে ধরিত্রীর স্পর্শেই তোমাদের নগ্ন পদযুগল মহানন্দে মাতোয়ারা আর তোমাদের দীর্ঘ কেশদামে নৃত্যছন্দে আকুল সুশীতল সমীর, সেই তো জীবনের প্রাণধর্ম্ম।



সূত্র:দরবেশ,সামহোয়ারইনব্লগ.কম

No comments:

Post a Comment