Friday, July 22, 2011

দ্য প্রফেট অনুবাদ-06


অতঃপর এল এক সরাইখানার বৃদ্ধ মালিক এবং তাকে বলল, তুমি আমাদের পানভোজনের ব্যাপারে কিছু বল
এবং সে বলল:

তোমরা কি ধরিত্রীর সৌরভে ঘ্রাণ নিয়ে বাঁচতে পারো কিংবা বায়ুবৃক্ষের মত সূর্য্যের আলোকে প্রাণধারণ করতে।
যখন প্রাণ ধারণের জন্য তোমাদের প্রাণ নিধন করতেই হয় কিংবা তৃষ্ণা নিবারণের জন্য তোমাদের নবজাতকের মাতৃদুগ্ধ হরণ করতেই হয়, তবে তা যেন হয় উপাসনা উপচার, তবেই তো পারো তোমরা প্রাণধারণ করতে


তোমাদের ভোজনস্থল হ’য়ে উঠুক সেই উপাসনাবেদী, অরণ্যভূমির নিষ্পাপ পূতপবিত্র প্রাণপশুরা উৎসর্গিত হউক্ সেখানে এবং সেই তারা হ’য়ে উঠুক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ মানুষের অন্তরেতে।

যখন কোন প্রাণপশুকে বধ করবে তোমরা যেন বোলো তোমাদের অন্তরেতে:
’যে শক্তি দ্বারা তুমি বধ্য হচ্ছ, আমরাও বধ্য হব আমরাও ভোজ্য হব সেই শক্তিতে।
’যে বিধিবিধানে তোমার সমর্পণ আমাদের হাতে, সেই বিধিবিধানেই আমরাও সমর্পিত হব তাঁর হাতে সেই সর্ব্বময় শক্তিতে
’যে প্রাণবারিতে স্বর্গীয় বৃক্ষ সিঞ্চিত সঞ্জীবিত সে তো তোমার সে তো আমাদেরই রক্তশোণিত, সেই প্রাণরসই আমাদেরই রক্তশোণিতে।’

এবং যখন আপেল ফলকে দন্তদংশিত করবে তোমরা যেন বোলো তোমাদের অন্তরেতে:
’তোমার বীজবৃক্ষের নিবাস হবে আমাদের শরীরেতে
’তোমার অনাগত কালের পুষ্পকুঁড়ি প্রষ্ফুটিত হবে আমাদেরই হৃদয়াবাসে
’তোমার সুরভি সুবাস স্বনিত হবে আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসে
’এবং আমরা বিনন্দিত হব সমস্ত ঋতু কালচক্রে একই সঙ্গে সহবাসে।’
এবং পেষাইয়ের জন্য আঙ্গুর ফল তুলবে যখন শরতে
তখন তোমরা যেন বোলো তোমাদের অন্তরেতে:
’আমরাও এক দ্রাক্ষাকুঞ্জ, আমাদের ফলও আহৃত হব পেষাইয়ের জন্য নিঃশেষে
’নূতন মদিরার মত আমরাও গচ্ছিত হব চিরন্তন কোন আধাররসে।’
এবং শীতে যখন সেই সুরাসুধা পান করবে তোমরা, তোমাদের হৃদয়ে যেন ঝঙ্কৃত হয় প্রতিটি পানপেয়ালার সঙ্গীত সুধাগীতি
এবং সেই সঙ্গীতে যেন ঝঙ্কৃত হয় শরতদিন দ্রাক্ষাক্ষেত আর পেষাইযন্ত্রের স্মরণস্মৃতি।

অতঃপর হলকর্ষক একজন বলল, তুমি আমাদের কর্ম্মকৃষ্টি সম্পর্কে কিছু বল এবং জবাবে সে বলল:

তোমরা কর্ম্ম কর, এই জগৎদুনিয়ার সান্নিধ্যে এই জগৎদুনিয়ার আত্মার সঙ্গে সঙ্গে একাত্ম হ’য়ে চল।
নিষ্কর্ম্ম অলস হ’য়ে থাকা তো ঋতুপ্রবাহে অধরা অনাবাসী হ’য়ে পড়া
জীবনের রাজসিক মর্য্যাদার পথে জীবনের অনন্তর শোভাযাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন হ’য়ে পড়া এবং সগর্ব্বে সেই অনন্ত অসীমে উৎসর্গিত হওয়া থেকে পিছিয়ে পড়া।

তোমরা যখন কর্ম্ম কর তোমরা যেন সব সুরবংশী যার হৃদতন্ত্রী থেকে নিঃসৃত হ’য়ে চলে কালস্রোতের ফিসফিসানি গুঞ্জনসঙ্গীত।
তোমরা এমন কে আছো যে বেণুবংশের মত নীরব নির্ব্বাক হ’য়ে থাকবে যখন জগৎদুনিয়ার সবকিছু সমবেত ঐকতানে গুঞ্জরিত হ’য়ে চলে বৃন্দসঙ্গীত।

তোমরা সব সময় শুনে এসেছো, কর্ম্ম হ’ল অভিসম্পাত আর শ্রম হ’ল দুর্ভাগ্য দুর্ভার।
আমি তোমাদের বলি, যখন তোমরা শ্রমকর্ম্ম কর তখন তোমরা ধরাভূমের এক দূরান্ত স্বপ্নসাধন কর অপার
সেই স্বপ্ন ভূমিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্তেই তোমাদের উপর ন্যস্ত হয়েছে তার ভার।
তোমাদের শ্রমকর্ম্মেই নিহিত হ’য়ে আছে জীবনের প্রতি তোমাদের ভালোবাসা অপার
শ্রমে কর্ম্মে জীবনকে ভালোবাসা তো আসলে জীবনের অন্তরতর রহস্যে প্রগাঢ় অন্তরঙ্গতা হওয়া তার।
নিদারুণ মর্ম্মযন্ত্রনায় তোমরা যদি তোমাদের জীবনজন্মকে বল ললাটলিখন উৎপীড়ণ আর রক্তমাংসের শরীরের ভরণপোষণকে বল ললাটলিখন অভিশাপ, আমি বলব তা কখনই নয়, বরং শ্রমের স্বেদে ওই ললাটলিখনকে ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলার দায়িত্ব তোমাদেরই, আর কার।

তোমরা এমনও শুনেছ, জীবন হ’ল তামসিক। এবং জীবনক্লান্তিতে তোমরাও জীবনক্লান্তদের কথাই আওড়ে চল, জীবন হ’ল তামসিক।
আমি বলি, প্রেরণা ব্যতীত জীবনই আদপে তামসিক
এবং জ্ঞান-অভিজ্ঞান ব্যতীত সমস্ত প্রেরণা-অনুপ্রেরণাই অন্ধ ঐকান্তিক
কর্ম্ম ব্যতীত কোন্ জ্ঞানই বা পরমার্থিক
ভালোবাসা ব্যতীত সমস্ত কর্ম্মই অন্তঃসারশূন্য বাহ্যিক
এবং যখন ভালোবাসায় প্রাণিত হ’য়ে কর্ম্ম কর, তখন তোমরা নিজেদের সঙ্গে একে অপরের সঙ্গে নিবিষ্ট হও এবং নিবিষ্ট হও ঈশ্বরের সঙ্গে পরমার্থিক।
ভালোবাসার সঙ্গে কর্ম্মের সম্পর্ক যেমন
যেন তোমাদের হৃদতন্তু দিয়ে বসন বয়ন আর সেই বসনে তোমাদের প্রেমাষ্পদের আবরণ আভরণ
যেন তোমাদের মমতা দিয়ে সৌধ নির্ম্মান আর সেই সৌধে তোমাদের প্রেমাষ্পদের আবাসন
এ হ’ল যেন তোমাদের সযত্নে জমিতে বীজ বপন এবং মহানন্দে তার ফসল উত্তোলন আর সেই ফসলে তোমাদের প্রেমাষ্পদের প্রাণধারণ।
এ হ’ল তোমাদের অন্তরাত্মার প্রাণবায়ু দিয়ে সবকিছু গড়ে তোলা
তোমাদের প্রতি সকল স্বর্গবাসীদের শুভকামনা ও বরাভয় বিদিত হওয়া, কখনও না ভোলা।
কতবার তোমাদের আমি বলতে শুনেছি যেন তোমরা নিদ্রার ঘোরে বলছ, ’শ্বেতপাথরের যে কারিগর তার নিজের মনেরই আদলে মর্ম্মর মূর্তি গড়ে সে যে ধরিত্রীর বুকে হলকর্ষণ করে তার চেয়ে অনেক বড়,
’যে রামধুনুকে বাগ মানিয়ে মানুষের আদলে পোষাক রঞ্জিত করে সে যে নিজের হাতে আমাদের পাদুকা সেলাই করে তার চেয়ে অনেক বড়।’
নিদ্রার ঘোরে নয় বরং দ্বিপ্রহরের পরম জাগৃতিতে আমি তোমাদের বলি, বাতাস কখনও বিশাল ওকবৃক্ষের প্রতি মধুর প্রবচন ব্যক্ত করে না বড়
বরং মন্দবাতাসে ধ্বনিত ঘাসের চাপরার সঙ্গীত আরও মধুর বড়
এবং যে পরম ভালোবাসায় বাতাসের স্বরধ্বনিকে মধুর সঙ্গীতে ধ্বনিত করে সে-ই শুধু বড়, অনেক বড়।
কর্ম্ম হ’ল সেই সে কিছু যাতে ভালোবাসা মূর্ত হয়ে ওঠে।
যদি তোমরা অপ্রেমে অনিচ্ছায় কর্ম্ম কর তবে তোমাদের কর্ম্ম না করাই শ্রেয়, বরং তার চেয়ে তোমরা দেবালয়ের দ্বারে বসে তাদের ভিক্ষা গ্রহণ করবে যারা পরমানন্দে কর্ম্ম করে, যাদের কর্ম্মে ভালোবাসা মূর্ত হয়ে ওঠে।
যদি তোমরা অপ্রেমে অনিচ্ছায় রুটী সেঁকো তবে তিক্ত বিস্বাদ সেই রুটী মানুষের শুধুই অর্ধ্বেক ক্ষুধা নিবৃত্ত করবে
যদি তোমরা অসন্তোষে অনাগ্রহে আঙ্গুর পেষণ কর তবে সেই অসন্তোষ অনাগ্রহ সুধাসুরাকে বিষময় করে তুলবে
যদি তোমরা গানকে না ভালোবেসে সুরদেবীর কন্ঠে গান গাও তবে দিবসরাত্রির কলধ্বনি মানুষের কর্ণকে শ্রতিরুদ্ধ করবে।



সূত্র:দরবেশ,সামহোয়ারইনব্লগ.কম

No comments:

Post a Comment